বিনা যুদ্ধে তালেবান জঙ্গিদের হাতে চলে এলো আফগানিস্তান। তিন লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা কেন প্রতিরোধ করল না জানি না। আমেরিকা যে দেশেই গণতন্ত্র গড়ে দিতে চায়, লক্ষ্য করেছি, সেখানে যত না গড়া হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ধ্বংস। তালেবানের বিরুদ্ধে কুড়ি বছর সংগ্রাম করার পর, ৯ হাজার কোটি ডলার খরচ করে আফগান সেনাবাহিনীকে আধুনিক করার পর, হাতেনাতে তার ফল পেলো- তালেবানের মহাসমারোহে ক্ষমতায় আরোহণ! আমেরিকার বিদেশ-নীতি নিছক কৌতুক ছাড়া কিছু নয়।
তালেবান-অধিকৃত আফগানিস্তান থেকে আফগানরা ভয়ে পালাচ্ছে কেন! বিমানবন্দরের চিত্র দেখে যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের চোখে জল চলে আসবে। হাজার হাজার মানুষ মরিয়া হয়ে ছোটাছুটি করছে। বিমানে চড়ার জন্য কামড়াকামড়ি করছে। ভিতরে জায়গা হয়নি বলে বিমানের গায়ে চড়ে বসেছে। বিমানের ছাদ, ডানা, চাকা আঁকড়ে পড়ে রয়েছে, ভেবেছে লোকাল বাসের গায়ে চড়ে যেমন এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে চলে যেতে পারে, তেমন বোধহয় বিমানের গায়ে চড়েও এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে পারবে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষ এমনই করে। তালেবানরা তো তাদের মতোই আফগান! তালেবান যে আইনে দেশ চালাবে, সে তো তালেবানের তৈরি কোনও নিজস্ব আইন নয়।
সে আইন ধর্মীয় আইন! যে আফগানরা পালাচ্ছে, তারা তো মুসলমান, তবে ধর্মীয় আইনে তাদের এত ভয় কেন?
অপ্রিয় সত্য এই, যারা পালাচ্ছে তারা তালেবানের ভয়ে নয়, আইনের ভয়ে পালাচ্ছে। মুসলমানরাই সপ্তম শতাব্দীর আইনকে ভীষণ ভয় পায়। তারা ইসলামকে মানতে চায় নিজেদের পছন্দ মতো ব্যাখ্যা দিয়ে, নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী। দুনিয়ার তাবৎ শান্তিপ্রিয় মুসলমান যে ইসলামকে মানে, সেই ইসলাম মৌলবাদী ইসলাম নয়। ইসলামের সেই মৌলবাদ আজ শুধু সন্ত্রাসী দলগুলোই মানে।
তালেবান ধর্মীয় আইন যে নারীবিরোধী, মানবাধিকারবিরোধী, বাকস্বাধীনতাবিরোধী-তার জ্বলন্ত উদাহরণ এখন আফগানিস্তান। ধর্মপ্রাণ আফগানরাও বোঝে যে, কোনও রকম পরিবর্তন ছাড়া যদি তালেবানদের ধর্মীয় আইন জারি করা হয়, তবে মেয়েদের অধিকার বলে কিছু থাকবে না। মেয়েদের লেখাপড়া করার, চাকরি-বাকরি করার, ব্যবসা-বাণিজ্য করার, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার, বোরখা-নিকাব না পরার, স্বনির্ভর হওয়ার, সম্পত্তির সমানাধিকার পাওয়ার, মান-মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলার কোনও অধিকার থাকবে না। সামান্য স্বাধীনতা উপভোগ করতে চাইলেই ব্যভিচার করার অপবাদ দিয়ে মাটির তলায় অর্ধেক শরীর পুঁতে পাথর ছুড়ে মেয়েদের মেরে ফেলবে তালেবানরা। তালেবান ক্ষমতায় এসেই মেয়েদের অধিকারের ওপর হিংস্র থাবা বসায়।
কারণ তালেবান আইনে মেয়েদের স্বাধীনতা এবং অধিকার স্বীকৃত নয়। তালেবান যদি ধর্মীয় আইনে দেশ না চালিয়ে গণতন্ত্র এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে দেশ চালাতো, তাহলে কোনও আফগানকে ভয় পেয়ে কুঁকড়ে থাকতে হয় না, দেশ ছেড়ে পালাতেও হয় না। কিছুদিন আগে তালেবানের দখল করা এক অঞ্চলের একজন আফগান লোক দুঃখ করে বলেছেন, ‘তালেবান আসার পর আমরা ভীষণই হতাশ। বাড়িতে আমরা জোরে কথা বলতে পারি না, গান শুনতে পারি না, মেয়েদের শুক্রবারের বাজারে পাঠাতে পারি না। তালেবানরা পরিবারের সদস্য সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তালেবান সাব কমান্ডার তো বলেই দিয়েছে তোমরা ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলে তোমাদের মেয়েকে ঘরে রাখতে পারবে না, এটা পাপ, তাদের অবশ্যই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। ’
১৮ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের ঘরে রাখাটা নাকি পাপ। তালেবান সেনারা ১৫-এর বেশি এবং ৪৫-এর কম- এমন বয়সী মেয়েদের তালিকা চেয়েছে। তালেবান সেনাদের সঙ্গে এদের বিয়ে দেওয়া হবে। আইসিস সৈন্যরা মেয়েদের আহ্বান করেছিল আইসিসে যোগ দিতে, সেই মেয়েদের ওরা যৌনদাসী বানিয়েছিল। তালেবানরা তো বিয়ের নামে মেয়েদের যৌনদাসীই বানাবে।
সিরিয়া এসে গেছে আফগানিস্তানে। আফগানিস্তান এসে যাচ্ছে পাকিস্তানে, পাকিস্তান এসে যাচ্ছে বাংলাদেশে। একেই হয়তো বলে প্যান ইসলামিজম।
এই প্যান ইসলামিজমের ভুক্তভোগী হতে হবে উপমহাদেশের প্রত্যেককে! এই দায় কি পাকিস্তান সরকার, চীন বা রাশিয়ার সরকার নেবে না? শুনেছি এই তিন দেশের সহযোগিতা পেয়েই তালেবান এগিয়েছে। কী করে এই একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক দেশগুলো স্বাগত জানাতে পারে একদল বর্বর জঙ্গিকে, যারা সপ্তম শতাব্দীর অন্ধকারে দেশকে ছুড়ে দিয়ে সর্বনাশ করবে নারীর! যতই রাজনৈতিক স্বার্থ থাকুক, মানবতার ক্ষতি করে সেই স্বার্থ উদ্ধারে যারা ব্যস্ত থাকে, তাদের ক্ষমা নেই। আজ আফগান নারীদের হাজার বছর পিছিয়ে রাখার জন্য দায়ী থাকবে জঙ্গি তালেবান আর তাদের এই সময়ের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো।
তালেবান এখন আগের মতো দেখতে নয়। তারা এখন আগের চেয়ে ভালো গাড়ি চালায়, আগের চেয়ে ঝকঝকে অস্ত্র তাদের কাঁধে, তাদের পোশাকও আগের মতো নোংরা নয়। কোনও কোনও মিডিয়া বলছে তারা নাকি আগের চেয়ে উদারও হয়েছে, তারা এখন নারীর অধিকার মেনে নেবে। মেনে নেবে, তবে অবশ্যই শরিয়া আইন অনুযায়ী। কিন্তু মুশকিল হলো শরিয়া আইন নারীর অধিকার মানে না। এর আগে যখন তারা ক্ষমতায় ছিল, তখনো তো শরিয়া আইনই জারি করেছিল, সেই শরিয়া আইন ব্যবহার করেই তো তারা মেয়েদের রাস্তাঘাটে পেটাতো, মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিল, মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে চাকরি করা বন্ধ করে দিয়েছিল, প্রেম করার অপরাধে মেয়েদের পাথর ছুড়ে মেরে ফেলতো।
তালেবানকে সরিয়ে যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারা বড় বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার ছিল। আফগান জনগণ তালেবান দ্বারাও ভোগে, তালেবানবিরোধী সরকার দ্বারাও ভোগে। এমনই দুর্ভাগা জনতা!
লক্ষ্য করেছি আফগান মেয়েদের পক্ষে সারা পৃথিবীর মুসলমান সেভাবে দাঁড়াচ্ছে না, যেভাবে ফিলিস্তিনি মেয়েদের পক্ষে দাঁড়ায়। এর একটিই উপসংহার, মুসলমানকে যখন মুসলমানরা মারে, মুসলমান চুপ থাকে। মুসলমানকে যখন অমুসলিমরা মারে, তারা ক্ষেপে আগুন হয়ে ওঠে। এটি খুব খারাপ লক্ষণ।
মেয়েরা যাদের দ্বারাই অত্যাচারিত হোক, রুখে উঠতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে।
তালেবানের আফগানিস্তানে আশঙ্কা করছি, ঠাঁই হবে হরেক রকম ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। তালেবানের রাজত্বকালে যেমন হয়েছিল। ওসামা বিন লাদেন এবং তার আল-কায়েদা সন্ত্রাসী দল আফগানিস্তানেই বাস করতো, আর পৃথিবী ধ্বংস করার নীলনকশা আঁকতো। বিজয়ী তালেবান এখন ঘোষণা করেছে, ইসলাম শুধু আফগানিস্তানে নয়, ইসলাম তারা সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করবে। বিশ্বকে দারুল ইসলাম বানাবে। সারা বিশ্বে ইসলাম ছাড়া আর কোনও ধর্ম থাকবে না, মুসলমান ছাড়া আর কোনও মানুষ থাকবে না। এই যদি হয় তাদের স্বপ্ন, তবে আশঙ্কা হয় অমুসলিম নাগরিকদের অবস্থা তালেবানামলে কী হবে! গতকাল একটি ভিডিওতে দেখলাম কিছু তালেবান সেনা পাকিস্তানের সীমান্ত প্রহরীদের হাসতে হাসতে বলছে, ‘অপেক্ষা করো, তোমাদের দেশ দখল করতে শিগরি আসছি। ’ পাকিস্তান দখল করতে পাকিস্তানে প্রবেশের দরকারও বোধহয় নেই। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো তালেবানদের সমর্থন করছেন, বলছেন তালেবানরা নাকি দাসত্বের শেকল ছিঁড়েছে। আফগানিস্তানে আমেরিকার সৈন্য যখন ছিল, তালেবানদের আশ্রয় দিয়েছিল পাকিস্তান। তালেবানের জন্মদাতাই তো পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। পাকিস্তানের হাজার হাজার মসজিদ মাদরাসায় এতকাল মানুষের মগজধোলাই করা হয়েছে আফগানিস্তানে গিয়ে জিহাদ করার জন্য। তালেবান সৈন্যদের মধ্যে পাকিস্তানের জিহাদি কিন্তু কম নেই। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা তালেবানের বিজয়ে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। তারাও আফগানিস্তানে গিয়ে নব্বই দশকের মতো তালেবানি প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে দেশকে আফগানিস্তান বানানোর চেষ্টা করবে।
মনে আছে সেইসব দৃশ্য, নীল বোরখায় আপাদমস্তক ঢাকা মেয়েদের যখন জনসমক্ষে চাবুক দিয়ে পেটাতো তালেবানরা, আর মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো আর হাততালি দিত! বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকেও শরিয়ার চাবুক থেকে বাঁচতে পারেনি মেয়েরা, এখনো পারবে না।
নারীর পরনে যে দাসত্বের শৃঙ্খল, তা ভেঙে ফেলতে কয়েক শতাব্দী লেগেছে। কিন্তু সেই শৃঙ্খল আবার পরিয়ে দিতে কিন্তু দুদিনও লাগে না। তালেবানের রাষ্ট্রে হারিয়ে যাবে কত সহস্র প্রতিভাময়ী নারী, পাথর ছুড়ে মারা হবে কত সহস্র সাহসী নারীকে-এসব কেউ মনে রাখবে না। ধর্মের আরেক নাম পুরুষতন্ত্র। মানবতার জন্য, মানব জাতিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে নারীবিদ্বেষী দর্শনকে বর্জন করার সময় অনেক আগেই এসেছে, এখন তার চূড়ান্ত সময়। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, নারীবিদ্বেষ পুরুষকে রক্ষা করবে না। পুরুষকে টিকে থাকতে হলে নারীর সঙ্গে সমানাধিকার আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমেই টিকে থাকতে হবে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।