চলমান লকডাউনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই সড়ক-মহাসড়ক, নৌপথে নেমেছে ঘরমুখো মানুষের ঢল। এমতাবস্থায় সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঘরমুখো মানুষের কাছে যেনো অসহায় হয়ে পড়েছে প্রশাসন। এর আগে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ঈদযাত্রাকে নিরুৎসাহিত করতে দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। তবুও শুক্র ও শনিবার ঢাকা ছাড়তে মরিয়া মানুষের ঢল নামে সড়ক ও নৌপথে। মাওয়া পয়েন্টে জরুরি ও পণ্যবাহী পরিবহন চলাচলের জন্য যে ফেরিগুলো চালু ছিলো, সেগুলোতেও মানুষের চাপে গাড়ি তোলাই সম্ভব হয়নি। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার লকডাউনের মধ্যে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তার অংশ হিসেবে ফেরিঘাটগুলোও বন্ধ থাকার কথা; শুধু জরুরি পরিবহনের জন্য কিছু ফেরি চলাচল করার কথা। এছাড়া মানুষের গ্রামে ফেরা ঠেকাতে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে ছুটি কমিয়ে দেয়া এবং চাকরিজীবীদের কর্মস্থল ত্যাগ না করার মতো নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু এসব বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই বেসরকারি উদ্যোগে অনেক লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল করছে, তারা অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত যাত্রীও তুলছে। ঘটছে গত ৩ মে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে একটি স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যুর মতো ঘটনাও। আবার নৌপথ ছাড়াও গত বৃহস্পতিবার থেকে জেলা শহরের মধ্যে বাস চলাচলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর দেখা যাচ্ছে— অনেকেই দুটি জেলার সীমান্তে গিয়ে যানবাহন পরিবর্তন করে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। যানবাহন পরিবর্তনে ব্যবহার হচ্ছে ব্যাটারিচালিত গাড়ি। ভাড়া গুণছেন তিনগুণেরও বেশি। সড়ক ও নৌপথের এ যখন অবস্থা, তখন নৌপথে মানুষের ঢল মোকাবিলায় গতকাল রীতিমতো অসহায় প্রশাসনকে মানুষের যাতায়াতের জন্য ব্যবস্থাও করে দিতে হয়েছে ফেরির। এর আগে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে শুক্রবার রাতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ঘোষণা দেয়, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে শনিবার থেকে যাত্রীবাহী কোনো ফেরি দিনে চলবে না। গভীর রাতের সেই ঘোষণায় ঘরমুখী অনেক যাত্রী সকালে ঘাটে এসে পড়েন বিপাকে। শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব বয়সি হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করতে থাকেন কখন ছাড়বে ফেরি। পার হয়ে যাবেন স্বজনদের কাছে। একপর্যায়ে মানুষের ভোগান্তি দেখে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়, ‘মানবিক কারণে’ ছাড়া হবে তিনটি ফেরি। এরপর দুপুরে তিনটি ফেরি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ছেড়েছে কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, মানবিক কারণে এ ফেরি চলাচল শুরু করা হয়েছে। যে তিনটি ফেরি ছেড়েছে তার মধ্যে একটি ছোট ও দুটি বড়। সেসব ফেরিতে পার হচ্ছেন সাধারণ যাত্রী ও ব্যক্তিগত যানবাহন। তবে অতিরিক্ত গাড়ির চাপে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। গাদাগাদি করে ফেরিতে লোক উঠে নদী পার হয়েছেন। তিনটি ফেরিতে ১১ হাজারেরও বেশি যাত্রী পার হতে পারলেও ঘাটে পারের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে আরও হাজার হাজার যাত্রীকে। কয়েকশ পণ্যবাহী ও ব্যক্তিগত গাড়িও পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
বিআইডব্লিটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম জিল্লুর রহমান জানান, সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সবকটি ফেরিঘাটে নোঙর করে রাখা হয়। এরপর বেশ কয়েকটি লাশবাহী গাড়ি ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ঘাটে এলে তাদের পারাপারের জন্য ছোট একটি ফেরি ছাড়া হয়। তখন ফেরির সঙ্গে কিছু মানুষ পার হয়। তবে ফেরিতে মানুষ পার করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা প্রশাসন বলতে পারবে’। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বিএম রুহুল আমিন বলেন, ‘লাশবাহী ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সকালে দুটি ফেরি পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া ছেড়ে গেছে। তবে সাধারণভাবে ফেরি চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। আমি খোঁজ নিচ্ছি।’ শিবালয় সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানিয়া সুলতানা বলেন, ‘অনেক শিশু, নারী ও বয়স্ক নারীদের কথা বিবেচনা করে দুই-তিনটি ফেরি চলাচল করছে। সাধারণ কোনো ফেরি চলেনি। যে কয়টি ফেরি চলাচল করছে সেগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স ছিলো। এদিকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটেও ঘরমুখো মানুষের চাপে ফেরি দিয়ে পারপার করা হয়েছে যাত্রী ও যানবাহন। তারপরও ঘাটে হাজারো যাত্রীর ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি মানা তো দূরের কথা মাস্কও পরতে দেখা যায়নি কাউকেই। যদিও শনিবার ভোর থেকে এই নৌরুটে সকল ফেরি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের চাপে কুঞ্জলতা নামে একটি ফেরি দিয়ে যাত্রী পারাপার করতে বাধ্য হয় ঘাট কর্তৃপক্ষ। এর আগে একপর্যায়ে ফেরি বন্ধের নির্দেশ দেয়া হলেও ঘাটে যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ আর তাদের রোষানলে পড়েই ফেরি চালাতে বাধ্য হয় বলে জানিয়েছে ঘাট কর্তৃপক্ষ। ঘাট কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল সোয়া ৮টায় বাংলাবাজার থেকে সাতটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে একটি ফেরি শিমুলিয়া ঘাটে আসে। সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে ফেরিতে উঠে পড়ে। শত নিষেধ সত্ত্বেও গাদাগাদি করে ফেরিতে উঠে যায় মানুষ। পরে ফেরিটি এই মানুষ নিয়েই ঘাটের অদূরে নোঙর করে রাখা হয়। কিছু সময় পর ফেরিটি ঘাটে ফিরিয়ে জনতাকে নামিয়ে দেয়। এ সময় ফেরি বন্ধ থাকায় যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। যাত্রীদের রোষানলে পড়েন ঘাট কর্তৃপক্ষের লোকজনও। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শ অনুসারে পরে ফেরি কুঞ্জলতায় যাত্রীবোঝাই করে মাদারীপুর ঘাটে পাঠানো হয়। এ ছাড়া দুপুর ১২টার পর আরও দুটি ফেরি ঘাট ছেড়ে যায় বলেও জানা গেছে। এদিকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অনেক কষ্টে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ভেঙে ভেঙে আবার হেঁটে পরিবার নিয়ে ঘাটে পৌঁছেছেন তারা। এখন ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই ঘাট এলাকায় অবস্থান করছেন তারা।
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ১১ হাজার মানুষ নিয়ে ঘাট ছেড়েছে তিন ‘মানবিক’ ফেরি
বিশেষ কায়দায় রাজধানী ছাড়ছে মানুষ গুণতে হচ্ছে তিনগুণেরও বেশি ভাড়া
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ চলছে দূরপাল্লার বাসও
এক জেলা থেকে আরেক জেলা পার হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোবাইকে
এর আগে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, করোনা বিস্তার রোধে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক শনিবার থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে দিনের বেলায় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে রাতে পণ্যবাহী পরিবহন পারাপারের জন্য ফেরি চলাচল করবে। তিনি বলেছিলেন, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এদিকে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে গত দুদিন ধরেই সড়ক পথেও ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। এ জন্য গতকাল সকালে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। ধীরগতিতে চলাচল করে যানবাহন। এ ছাড়াও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে চলছে দূরপাল্লার বাস ও সিএনজি। মহাসড়কের ঘারিন্দা, কান্দিলা, রাবনা, বিক্রমহাটি, রসুলপুর ও এলেঙ্গা এলাকায় এ দৃশ্য দেখা যায়। এ ছাড়া ট্রাক ও মাছের গাড়িতে করোনার ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেখা গেছে। অপরদিকে বাস, প্রাইভেটকারসহ ব্যক্তিগত গাড়িতে গাদাগাদি করে চলাচল করছে সাধারণ মানুষ। সরেজমিন দেখা গেছে, ঈদকে কেন্দ্র করে ঘরমুখো মানুষের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যার যার মতো গন্তব্য ছুটছে। বগুড়াগামী ট্রাকচালক হানিফ মিয়া বলেন, ‘সকাল থেকে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়ছে। ফলে ধীরগতিতে চলতে হচ্ছে। ঘারিন্দা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার আসতে ১০ থেকে ১২ মিনিট লাগলেও এখন সময় একটু বেশি লেগেছে। এ বিষয়ে এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইয়াসির আরাফাত বলেন, পাটুরিয়া দৌলদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া নির্দেশ অমান্য করায় দূরপাল্লার বাসকে মামলা দেয়া হচ্ছে।’ বেলা বাড়ার সাথে সাথে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হবে বলে তিনি জানান। সড়কে ঘুরে দেখা গেছে, দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও মানুষ রাজধানী ছাড়ছেন বিশেষ কায়দায়। সে জন্য গুনতে হচ্ছে তিনগুণ বেশি ভাড়া। তারপরও তারা বলেছেন— বাড়ি যেতে পেরে স্বস্তি মিলেছে। গতকাল রাজধানীর সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঘুরে সরেজমিন এ চিত্র দেখা যায়। গণপরিবহন না থাকলেও ঘরে ফেরা মানুষ গন্তব্যে যাচ্ছেন প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে প্রতিটি এলাকায় যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হচ্ছে তিনগুণ বেশি। কুমিল্লা যেতে সাধারণ সময়ের ২০০ টাকার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৬০০ টাকা। ফেনী যেতে ৩০০ টাকার ভাড়া দিতে হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা। নোয়াখালী যেতে ৭০০ টাকার ভাড়া আজ দুই হাজার টাকা। একই সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাড়াও গুনতে হচ্ছে তিনগুণ বেশি। এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক ফেডারেশনের সভাপতি এবং সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল সংবাদ সম্মেলনে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, এই এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা লকডাউনে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন পরিবহন শ্রমিকরা। দূরপাল্লার যাত্রীরা বেশি টাকা খরচ করে হয়রানি হয়ে শরীরের উপর চাপ নিয়ে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে এবং যাবে। এটাই স্বাভাবিক বলছেন তিনি।