ইতিহাসে এক আলোচিত নাম এম সাইফুর রহমান। বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করার কারণে এখন সিলেটসহ দেশবাসী শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করেন। আজ ৫ সেপ্টেম্বর সাইফুর রহমান এর ১২ তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশে ১২ বার জাতীয় বাজেট উপস্থাপনের করেন এম সাইফুর রহমান। সেই সাথে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রবর্তণ করেন তিনি। যে ক’জন মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের মধ্যে সাইফুর রহমান ছিলেন অন্যতম। দল এবং দেশের মানুষের জন্য তিনি ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ। কৃর্তী এই মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সিলেট বিভাগ সহ সারা দেশে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবার, সিলেট , মৌলভীবাজার ,জেলা ও মহানগর বিএনপির পাশাপাশি সাইফুর রহমান স্মৃতি সংসদ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বৃহত্তর সিলেটবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে আজ ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সিলেট প্রেমিক’ হিসেবে অভিহিত এম সাইফুর রহমানকে। কীর্তিমান এ রাজনীতিবিদের অভাব এখনও অনুভব করছেন সিলেটের মানুষ। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। দীর্ঘ বিরতির পর সিলেট সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পথে ওইদিন বিকেল পৌনে ৩টায় ঢাকা-সিলেট মহসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের খাড়িয়াল এলাকায় দুর্ঘটনায় পতিত হয় সাইফুর রহমানকে বহনকারী গাড়ি। তাকে উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সাইফুর রহমানের আকস্মিক মৃত্যুতে সেদিন বৃহত্তর সিলেটসহ সারাদেশে অগণিত ভক্ত অনুরাগীর মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া।
মৌলভীবাজারের বাহার মর্দান গ্রামে ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণকারী সাইফুরের পুরো জীবন ছিল উজ্জ্বল কর্মময়। বিলেত ফেরত এ চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট আপন যোগ্যতাবলেই দেশের অর্থমন্ত্রী হন একাধিকবার। দেশের জাতীয় সংসদে সর্বাধিক সংখ্যক বাজেট উপস্থাপন করে হয়ে যান বিশ্ব রেকর্ডধারী। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত সরকারগুলোয় ছিলেন নির্ভরযোগ্য অর্থমন্ত্রী। অথচ ছাত্রজীবনে তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট। তাকে সর্বপ্রথম রাজনীতিতে আনেন বিএনপির প্রতিষ্টাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সাইফুর রহমান বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাকে বাণিজ্যমন্ত্রী করা হয়। জাতীয় গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সাইফুর রহমান। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ব্যানারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছিলেন, সেই ফ্রন্টেরও সদস্য ছিলেন তিনি। জাগদল বিলুপ্ত করে ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্টিত হয়। সে দলেরও প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিলেটের কৃতি সন্তান সাইফুর রহমান। তখন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয় তাকে। এম সাইফুর রহমান ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে লেটার মার্ক পেয়ে মেট্রিক, ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য লন্ডনে যান এবং ১৯৫৮ সালে চাটার্ড অ্যাকাউটেন্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এম সাইফুর রহমান ১৯৬০ সালের ১৫ জুলাই বেগম দুররে সামাদ রহমান সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ।
১৯৭৯ সালে তিনি মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে প্রথমমবারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য মনোনীত হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে সিলেট-৪ (জৈন্তা-গোয়াইনঘাট) ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে, ২০০১ সালে সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই সময় তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সাইফুর রহমান ১৯৯৪-৯৫ সালে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান, ১৯৮০-৮২ ও ১৯৯১-৯৫ সময়কালে তিনি বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয় ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ও ইফাড এর বাংলাদেশ গর্ভনরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি একনেকের চেয়ারম্যান ছিলেন। সিলেটের বুকে সাইফুর রহমানের পদচিহ্ন আর কোনো দিন পড়বে না। কিন্তু সিলেটবাসীর হৃদয়ে আজীবন জেগে থাকবেন এ মানুষটি। বাজেট পেশের দিক থেকে বিএনপির এম সাইফুর রহমানের রেকর্ডটি সবচেয়ে বড়। তিনি বাজেট দিয়েছেন ১২টি। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান মারা গেলে বিএনপিতে নেমে আসে দুঃসময়। তখন সাইফুর রহমান বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সরকার সাইফুর রহমানকে গ্রেফতার করে। ৭ মাস কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে সাইফুর রহমান খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে রাজনীতিতে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে এম সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।